সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান
শীতকালীন আবাদ --CAJ পর্ব ০৪:

সয়াবিন চাষ:
বাংলাদেশে সয়াবীন একটি সম্ভাবনাময় ফসল। আমিষ ও ভোজ্য তেল উৎপাদনে সয়াবীন এখন অনেক দেশেই একটি প্রধান ফসল।

পুষ্টি উপাদান/মূল্য ও ভেষজগুণঃ প্রোটিন বিদ্যমান। অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড থাকে বিধায় হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্ত চাপ রোগীদের জন্য বিশেষ উপকারী।


ব্যবহারঃ সয়াবিন ডাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া পিয়াজু, বড়া, দুধ, চাপাতি, পরটা, পাউরুটি, বিস্কুট, পিঠাসহ আরও অনেক খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে পোল্ট্রি শিল্পে সয়াবিন ব্যবহৃত হচ্ছে।

উপযুক্ত জমি ও মাটিঃ দো-আঁশ, বেলে-দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ মাটি সয়াবিন চাষের উপযোগী।

জাত পরিচিতিঃ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সয়াবিনের ৩টি জাত উদ্ভাবন করেছেন। জাতগুলোর বৈশিষ্ট্য নিম্নে উল্লেখ করা হলো।

সোহাগ (পিবি-১): সংগৃহীত জার্মপ্লাজম থেকে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৯৯১ সালে সরকার কর্তৃক জাতটির  অনুমোদন দেয়া হয়।ফুলের রং বেগুনী। বীজের রং উজ্জ্বল হলদে। বীজ সংরক্ষণ ক্ষমতা ভালো। ১০০ বীজের ওজন ১১-১২ গ্রাম। এজাতটি পাতার হলদে মোজাইক রোগ সহনশীল। জীবনকাল রবি মৌসুমে ১০০-১১০ দিন এবং খরিপ মৌসুমে ৮০-৯০ দিন। হেক্টর প্রতি ফলন ১.৫-২.০ টন।

বারি সয়াবিন-৪ (জি-২): ১৯৯৪ সালে জাতটির অনুমোদন দেয়া হয়। এ জাতের বীজের আকার ছোট।  ১০০ বীজের ওজন ৫-৭ গ্রাম। বীজের রং হলদে। জাতটি পাতার হলদে মোজাইক রোগ সহনশীল। জাতটির জীবনকাল ৯০-১২০ দিন। হেক্টর প্রতি  ফলন ১.৮-২.০ টন।

বারি সয়াবিন-৫: ২০০২ সালে জাতটির অনুমোদন দেয়া হয়। এজাতটি সব মৌসুমেই চাষ করা যায়।  এ জাতের প্রতিটি গাছে ফলের সংখ্যা ২৫-৩২ টি। শুটিতে বীজের সংখ্যা ২-৩  টি। বীজের আকার সোহাগের চেয়ে সামান্য ছোট এবং বাংলাদেশ সয়াবিন-৪ এর  বীজের চেয়ে বড়। বীজের রং ক্রীম এবং শত বীজের ওজন ৯-১৪ গ্রাম। জীবনকাল ৯০- ১০০ দিন। হেক্টর প্রতি ফলন ১.৬-২.০ টন।

বারি সয়াবীন-৬: জাতটি বাংলাদেশের সব জায়গায় রবি ও খরিফ-২ মৌসুমে চাষ উপযোগী। রবি মৌসুমে মধ্য ডিসেম্ভর থেকে মধ্য জানুয়ারি এবং খরিফ-২ মৌসুমে জুলাই মাসে বপনের উপযুক্ত সময়। জাতটি বপন থেকে পরিপক্ক হতে ১০০-১১০ দিন সময় লাগে। জাতে ২০-২১% তেল এবং ৪২-৪৪% প্রোটিন থাকে। জাতটিতে মোজাইক ভাইরাসের আক্রমণ কম হয়। জাতটির হেক্টর প্রতি ফলন ১.৮০-২.২০ টন।

বীজ বপনঃ বাংলাদেশে রবি এবং খরিপ উভয় মৌসুমেই সয়াবিনের চাষ করা যায়। তবে #পৌষ মাসে (মধ্য ডিসেম্বর থেকে মধ্য জানুয়ারী) বপন করা ভাল। অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে শ্রাবণ মাস থেকে মধ্য  ভাদ্র মাস পর্যন্ত বপন করা যায়।

বীজের হারঃ সোহাগ- ৮০ কেজি/হেঃ। জি-২ - ৪০-৪৫ কেজি/হেঃ।

বপন পদ্ধতিঃ সয়াবিন সারি করে বপন করা ভালো। তবে ছিটিয়েও বুনা যায়। সারিতে বপন করলে সারি  থেকে সারির দূরত্ব রবি মৌসুমে ৩০ সে.মি. এবং খরিপ মৌসুমে ৪০ সে.মি. দিতে  হবে। গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হবে ৫-৬ সে.মি.। বীজ বপনের গভীরতা হবে ৩-৪ সে.মি.।
সার ব্যবস্থাপনাঃ
হেক্টর প্রতি সারের পরিমাণ নিম্নরূপঃ
সারের নাম----------প্রতি হেক্টরে (কেজি)
ইউরিয়া----------------৫০-৬০ কেজি
টিএসপি---------------১৫০-১৬০ কেজি
এমওপি----------------১০০-১২০ কেজি
জিপসাম---------------৮০-১১৫ কেজি
শেষ চাষের সময় সবটুকু সার জমিতে প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।

অণুজীব সার প্রয়োগঃ ছায়াযুক্ত স্থানে এক কেজি বীজের মধ্যে ৬৫-৭৫ গ্রাম অণুজীব সার মিশিয়ে ভালোভাবে নাড়াচাড়া করে বীজ সাথে সাথে বপন করতে হবে। সাধারণত এই সার ব্যবহার করলে ইউরিয়া সার ব্যবহারের প্রয়োজন হয়না।

সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনাঃ রবি মৌসুমে বীজ বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে (ফুল আসার সময়)। প্রথম সেচ  এবং দ্বিতীয় সেচ বীজ বপনের ৫৫-৬০ দিনের মধ্যে (শুটি গঠনের সময়) দিতে   হবে। খরিপ মৌসুমে সেচের প্রয়োজন হয়না তবে প্রয়োজনে সম্পূরক সেচ দেয়া যেতে পারে। চারা গজানোর ২০-২৫ দিন পর আগাছা
দমন করতে হবে।

রোগবালাই ব্যবস্থাপনাঃ
পোকার নামঃ  বিছা পোকা---
সয়াবিনের একটি মারাত্মক পোকা। ছোট অবস্থায় এরা দলবদ্ধভাবে থাকে। কীড়া বা বিছা হলুদ রংয়ের এবং গায়ে কাঁটা থাকে। এরা সাধারণত গাছের পাতায় আক্রমণ করে। এ পোকার কীড়া দলবদ্ধভাবে থেকে পাতার  সবুজ অংশ খেয়ে পাতাকে পাতলা সাদা পর্দার মতো করে ফেলে।
ব্যবস্থাপনাঃ পোকা দেখার সংগে সংগে গাছ থেকে পোকাসহ পাতা সংগ্রহ করে পোকা মেরে ফেলতে হবে। সেচ নালায় কেরোসিন মিশ্রিত পানি থাকলে কীড়া পানিতে পড়ে মারা যায়। প্রতি লিটার পানিতে ডায়াজিনন-৬০ ইসি ২ মিলি হারে মিশিয়ে বিকালে জমি করতে হবে।
রোগের নামঃ হলুদ মোজাইক ভাইরাস---
সয়াবিনের সবুজ পত্র ফলকের উপরিভাগে উজ্জ্বল সোনালী বা হলুদ রংয়ের চক্রাকার দাগের উপস্থিতি দেখা যায়। তখন হলদে পাতাযুক্ত আক্রান্ত গাছ সাধারণত খাটো এবং বামনাকৃতি হয়ে থাকে। মেঘলা আবহাওয়ায় এ রোগটি বৃদ্ধি পায়। জাব পোকার মাধ্যমে বিস্তার ঘটে।
ব্যবস্থাপনাঃ বালাই সহনশীল জাত যেমন বাংলাদেশ সয়াবিন-৪এর আবাদ করা। আক্রান্ত গাছ বাছাই করে (রগিং) তুলে মাটির নিচে পুঁতে রাখা। রোগমুক্ত বীজ বপন। ২ মিলি হারে মিশিয়ে জমিতে ভালোভাবে সেপ্র করতে হবে।
রোগের নামঃ কান্ড পঁচা রোগ---
এ রোগ সাধারণত স্কেলেরোশিয়াম রলফসি/ফিউজারিয়াম/রাইজোকটনিয়া নামক ছত্রাকের সাহায্যে রোগ ছড়ায়। আক্রান্ত গাছের কান্ড এবং মূলে কালো দাগ পড়ে। পরবর্তীতে চারা বা গাছ ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায় এবং অবশেষে মারা যায়। ছত্রাকের সাহায্যে বিসত্মার।
ব্যবস্থাপনাঃ বীজ বপনের পূর্বে ভিটাভেক্স-২০০ দিয়ে (২.৫ গ্রাম/কেজি) বীজ শোধন করে বীজ বপন করতে হবে। গভীরভাবে জমি চাষ করতে হবে। জমি হতে ফসলের পরিত্যক্ত আঁশ, আগাছা, আবর্জনা পরিষ্কার করে রোগের উৎস নষ্ট করতে হবে।
ফসল তোলাঃ সয়াবীন বীজ বোনা থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত ৯০-১২০ দিন সময় লাগে। ফসল পরিপক্ক হলে শুটিসহ গাছ হলদে হয়ে আসে এবং পাতা ঝড়ে পড়তে শুরু করে। এ সময় গাছ কেটে ফসল সংগ্রহ করতে হয়।

তথ্যসূত্র : আপা প্রকল্প।

#সকল কৃষক বন্ধুদের জন্য শুভকামনা--চাষা আলামিন জুয়েল ॥

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সবজি ও ফল চাষের বারো মাসের পঞ্জিকা:,

সবজি ও ফল চাষের বারো মাসের পঞ্জিকা- - আমাদের দেশে সাধারণত ঋতু বা মৌসুম ছ’টি। আর কৃষির মৌসুম তিনটি- খরিফ-১, খরিফ-২ ও রবি। উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে যদিও কৃষি মৌসুমকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে, কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া, জলবায়ু এবং আমাদের প্রয়োজনের তাগিদে প্রতি মাসের প্রতিটি দিনই কিছু না কিছু কৃষি কাজ করতে হয়। চাষিরা নিজস্ব চিন্তা ধারা, চাহিদা ও আর্থিক দিক বিবেচনা করে নিজের মত প্রতিদিনের কাজ গুলোকে সাজিয়ে নিবেন ও বাস্তবে রূপ দেবেন।  ক্লিক করুন: বেগুন চাষ পদ্ধতি : https://smartfarmeralaminjuel.blogspot.com/2020/01/caj.html পশু পাখি ও তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় : https://smartfarmeralaminjuel.blogspot.com/2020/01/blog-post.html https://smartfarmeralaminjuel.blogspot.com/2020/01/blog-post_22.html বৈশাখ (মধ্য এপ্রিল-মধ্য মে): লালশাক, গিমাকলমি, ডাঁটা, পাতাপেঁয়াজ, পাটশাক, বেগুন, মরিচ, আদা, হলুদ, ঢেঁড়স বীজ বপন এর উত্তম সময় . সঙ্গে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চারা রোপণ করতে হবে । মিষ্টিকুমড়া, করলা, ধুন্দুল, ঝিঙা, চিচিংগা, চালকুমড়া, শসার মাচা তৈরি, চারা উৎপাদন করতে হবে . কুমড়া জাতীয় সব...

পরিবারিক খামারে দেশী জাতের মুরগী পালনের লাভজনক উপায় :

পারিবারিক খামারে দেশী জাতের মুরগী পালনের লাভজনক উপায়ঃ--- আমাদের গ্রামীণ জনপদে আগে বেশীরভাগ ঘরে দেশী মুরগী পালন করা হতো। রাত-বিরাতে বাড়ীতে অতিথি এলে এই মুরগী জবাই করে আপ্যায়নের ব্যাবস্থা করা হতো। এমনকি মাঝে মাঝে গভীর রাতেও মুরগীর ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যেতো। পরে জানতে পারতাম, মেহমান এসেছে তাই রাতেই মুরগী জবেহ করা হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে রাতে তো দুরের কথা, দিনের বেলাতে পুরো এলাকা খুঁজে বেড়ালেও দেশী মুরগী খুব বেশী পাওয়া যাবে না। কারন আজ আর গ্রামীণ জনপদের মানুষ দেশী মুরগী আগের মত পালন করে না। কিন্তু এর কারন কি ? কেন মানুষ দেশী জাতের মুরগী পালন করছে না ? কি এর প্রতিবন্ধকতা ? কেন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশী জাতের মুরগী ? সকলের অভিজ্ঞতালব্ধ মতামত কামনা করছি। এবং আপনাদের আলোচনা ও মতামতের আলোকে পরবর্তীতে দেশী জাতের মুরগী নিয়ে কিছু লেখার আশা করছি------- #উপরোল্লিখিত আহ্বানটি জানাই,আলোচনা/ মতামত গ্রহনের জন্য গত ২৫/০৭/২০১৬ ইং তারিখে। যাতে করে প্রকৃত কারন গুলো খুঁজে বের করে একটি ফলপ্রসূ সমাধান দেয়া যায় এবং দেশী মুরগী সফল ভাবে পালনে আবার সকলকে আগ্রহী করে তোলা যায়। আলহামদুলিল্লাহ্‌, অভুতপূর্ব সারা ...

পোল্ট্রি খামারি বন্ধুদের কিছু প্রশ্ন ও উত্তর :

পোল্ট্রি খামারি বন্ধুদের কিছু প্রশ্ন ও উত্তর : #মুরগীর রানীক্ষেত ঠেকাতে কি করবো ---? CAJউত্তর : প্রতিষেধক : বাচ্চাদের ৫-৭ দিন বয়সে বিসিআরডিবি টিকা চোখে ফোঁটা আকারে দিতে হবে। ২১ দিন বয়সে এবং ৬ মাসের বড় মোরগ-মুরগির জন্য আরডিভি ইঞ্জেকশন দিতে হবে। ১০০ মুরগির জন্য ১ টি ভায়াল যথেষ্ট। চিকিতসা : অক্সি টেট্রাসাইক্লিন গ্রুপের ওষুধ যেমন : রেনামাইসিন, বেক্টিট্যাব, টেট্রাভেট, টেকনোমাইসিন ডিএস যেকোনো একটি ট্যাবলেট ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ টি মুরগিকে ৩ দিন খাওয়ালে ভাল ফল পাওয়া যাবে। #মুরগির ই করাইজা (ঠান্ডা রোগ) হলে কী করবো--? CAJউত্তর : ঘরের ভেতর স্যাঁতস্যাতে ভাব দূর করতে হবে, আলো-বাতাসের পর্যাপ্ত প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে, লিটার সবসময় শুষ্ক রাখতে হবে। আক্রান্ত মুরগিকে আলাদা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। ডক্সিসাইক্সিন : ১ গ্রাম ২ থেকে ৩ লিটার পানিতে মিশিয়ে দিতে হবে এবং Ciprotrojin পাউডার: ১ লিটারে পানিতে ১ গ্রাম পরিমাণে ৫ দিন ধরে দিতে হবে। #মুরগির কলেরা হয়েছে (জ্বর থাকে,  প্রথম দিকে সবুজ ও সাদা পাতলা পায়খানা করে), কী করতে হবে--? CAJউত্তর: প্রথমত আক্রান্ত মুরগিকে দ্রুত আলাদা করে ...