মাছের রোগ বালাই ও প্রতিকার----
জীবিত প্রাণি রোগাক্রান্ত হবে, এটাই প্রকৃতিক নিয়ম এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মাছের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় না। তবে নানা কারণে উন্মুক্ত জলাশয়ের চেয়ে বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করা মাছে রোগাক্রমণ অনেক সময় কম বেশি হয়ে থাকে। পুকুর বা দীঘির মাছকে প্রায়ই নানান রোগের কবলে পড়তে দেখা যায়।আবদ্ধ পদ্ধতিতে চাষকৃত মাছ সচরাচর যেসব রোগে আক্রান্ত হতে পারে, এ ধরনের কয়েকটি সম্ভাব্য রোগ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করা হলো।
রোগের নাম/আক্রান্ত মাছের প্রজাতি/রোগের লক্ষন ও কারণ/চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ/প্রতিষেধক/প্রতিকারে নিম্মোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে ----
১) রোগের নাম - ছত্রাক রোগ (সেপ্রোল্গেনিয়াসিস):
আক্রান্ত মাছের প্রজাতি - রুই জাতীয় ও অন্যান্য চাষ যোগ্য মাছ।
রোগের লক্ষন ও কারণ:
আক্রান্ত মাছের ক্ষতস্থানে তুলার ন্যায় ছত্রাক দেখা দেয় এবং পানির স্রোত যখন স্থির হয়ে যায় কিংবা বদ্ধ জলায় অথবা হ্যাচারী ট্যাংকে যেখানে অনিষিক্ত ডিমের ব্যাপক সমাগম ঘটে, উহাতে ছত্রাক রোগ দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে। এমনি ধরনের প্রাকৃতিক জলাশয়ে প্রায় শতকরা ৯৮ ভাগ মাছের ডিম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেপ্রোলেগনিয়া প্রজাতি এ রোগের কারণ।
চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ:
ক. হ্যাচারিতে লালনকৃত ডিমগুলোকে ২৫০ পিপিএম ফরমালিন দিয়ে ধৌত করা।
খ. খাচা এবং পেনে চাষকৃত আক্রান্ত মাছগুলোকে শতকরা ৩-৫ ভাগ ফরমালিন দিয়ে ২-৩ মিনিট গোসল দেয়া।
গ. বিকল্প হিসাবে শতকরা ৫ ভাগ লবন পানিতে গোসল দেয়া যেতে পারে।
প্রতিষেধক/প্রতিকার:
ক. হ্যাচারীর প্রতিটি যন্ত্রপাতি ও ট্যাংক সম্পূর্ণরুপে পরিষ্কার করার পর শতকরা ১০ ভাগ ফরমালিন পানি দিয়ে ধৌত করা।
খ. অনিষিক্ত ও মৃত ডিমগুলোকে অবিলম্বে হ্যাচারি ট্যাংক থেকে সরিয়ে নেয়া এবং অধিক খাদ্য প্রয়োগ না করা।
২) রোগের নাম - মাছের ক্ষত রোগ: (ইপিজুটিকআরসারেটিভসিনড্রোম )
আক্রান্ত মাছের প্রজাতি - শোল, গজার, টাকি, পুঁটি, বাইম, কৈ, মেনি, মৃগেল, কার্পিও এবং তলায় বসবাসকারী অন্যান্য প্রজাতির মাছ।
রোগের লক্ষন ও কারণ:
এ রোগের মুল কারণ এ্যাফানোমাইসিস ইনভাডেনস্ নামক ছত্রাক দ্ধারা মূলতঃ মাছের মাংসপেশী আক্রান্ত হয়। এছাড়া কিছু ব্যবকটিরিয়া, প্রোটোজোয়া সংশ্লিষ্ট আছে বলে জানা যায়। রোগাক্রান্ত হওয়ার পূর্বে পানির গুনাগুনের অবনতি ঘটে, যেমন :
ক ) হঠাৎ তাপমাত্রার কমতি (১৯° সেঃ এর কম)।
খ ) পি, এইচ-এর কমতি (৪-৬)।
গ ) এ্যালকালিনিটির কমতি (৪৫-৭৪ পিপিএম)।
ঘ ) হার্ডনেস-এর কমতি (৫০-৮০ পিপিএম)।
ঙ) ক্লোরাইড এর স্বল্পতা (৩-৬ পিপিএম)।
মাছের ক্ষত রোগ চেনার উপায়:
আক্রান্ত মাছের গায়ে ক্ষত বা 'ঘা'জনিত লাল দাগ দেখা যায়। এই দাগের আকৃতি ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকবে। ঘায়ের স্থানে চাপ দিলে কখনো কখনো পুঁজও বের হতে পারে। মাছের লেজের গোড়া, পিঠ ও মুখের দিকেই বেশি ক্ষত হয়ে থাকে।
চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ:
ক. নিরাময়ের জন্য ০.০১ পিপিএম চুন ও ০.০১ পিপিএম লবন অথবা ৭-৮ ফুট গভীরতায় প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ১ কেজি হারে চুন ও ১ কেজি হারে লবন প্রয়োগ করলে আক্রান্ত মাছগুলো ২ সপ্তাহের মধ্যে আরোগ্য লাভ করে।
প্রতিষেধক/প্রতিকার:
ক. আগাম প্রতিকার হিসাবে আশ্বিন কার্তিক মাসে বর্ণিত হারে লবন ও চুনের প্রয়োগ করলে আসন্ন পরবর্তী শীত মৌসুমে মাছের ক্ষত রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়।
৩) রোগের নাম - ক্ষত রোগ:
আক্রান্ত মাছের প্রজাতি - সিলভার কার্প
রোগের লক্ষন ও কারণ:
ক. উপকূলীয় অঞ্চলে মাছ চাষের পুকুর বন্যায় প্লাবিত হলে ক্লোরাইডের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির (৩০ পিপিএম এর অধিক) ফলে কেবল মাত্র সিলভার কার্প মাছে দ্রুত ক্ষত রোগ দেখা দেয়।
চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ:
ক. আক্রান্ত পুকুরে তিন ভাগের দুই ভাগ পানি মিঠা পানির দ্ধারা পরিবর্তন করা।
খ. প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ৩/৪টি হারে চালতা ছেঁচে সারা পুকুরে ছড়িয়ে দিতে হবে।
প্রতিষেধক/প্রতিকার:
ক. বর্ণিতহারে চালতা প্রয়েগের ফলে ক্ষতরোগ আক্রান্ত সিলভার কার্প দ্রুত আরোগ্য লাভ করে।
খ. পুকুরকে বন্যামুক্ত রাখুন।
৪) রোগের নাম -পাখনা অথবা লেজ পঁচা রোগ:
আক্রান্ত মাছের প্রজাতি - রুই জাতীয় মাছ, শিং মাগুর ও পাঙ্গাস মাছ।
রোগের লক্ষন ও কারণ:
ক. প্রাথমিক ভাবে পিঠের পাখনা এবং ক্রমান্বয়ে অন্যান্য পাখনা আক্রান্ত হয়। এ্যারোমোনাড্স ও মিক্সোব্যাকটার গ্রুপের ব্যাকটেরিযা দ্ধারা এ রোগের সৃষ্টি হয়।
খ. পানির পি-এইচ ও ক্ষরতার স্বল্পতা দেখা দিলে এ রোগ দেখা দিতে পারে।
চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ:
ক. ০৫ পিপিএম পটাশযুক্ত পানিতে আক্রান্ত মাছকে ৩-৫ মিনিট গোসল করাতে হবে।
খ. পুকুরে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
প্রতিষেধক/প্রতিকার:
ক. রোগজীবানু ধ্বংসের পর মজুদকৃত মাছের সংখ্যা কমাবেন।
খ. প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করুন।
৫) রোগেরনাম - পেটফোলারোগ:
আক্রান্ত মাছের প্রজাতি - রুই জাতীয় মাছ, শিং মাগুর ও পাঙ্গাস মাছ।
রোগের লক্ষন ও কারণ:
ক. মাছের দেহের রং ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং পানি ও সঞ্চালনের মাধ্যমে পেট ফুলে যায়।
খ. মাছ ভারসাম্যহীনভাবে চলাচল করে এবং পানির ওপর ভেসে থাকে । অচিরেই আক্রান্ত মাছের মৃত্যু ঘটে।
গ. এ্যারোমোনাড্স ব্যাকটেরিয়া এ রোগের কারণ।
চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ:
ক. খালী সিরিঞ্জ দিয়ে মাছের পেটের পানিগুলো বের করে নিতে হবে। প্রতি কেজি মাছের জন্য ২৫ মিঃ গ্রাঃ হারে ক্লোরেমফেনিকল ইনজেকশন দিতে হবে। অথবা,
খ. প্রতি কেজি খাবারের সাথে ২০০ মিঃ গ্রাঃ ক্লোরেমফেনিকল পাউডার মিশিয়ে সরবরাহ করা।
প্রতিষেধক/প্রতিকার:
ক. প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করুন।
খ. মাছের খাবারের সাথে ফিশমিল ব্যবহার করুন।
গ. মাছকে সুষম খাদ্য সরবরাহ করবেন।
ঘ. প্রাকৃতিক খাবার হিসেবে প্লাংকটনের স্বাভাবিক উৎপাদন নিশ্চিত করুন।
৬) রোগের নাম - সাদা দাগ রোগ:
আক্রান্ত মাছের প্রজাতি - মৃগেল ও রুই মাছের পোনা।
রোগেরলক্ষন ও কারণ:
ক. পোনা মাছের আঁইশ, পাখনাসহ সারা দেহে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাদা দাগ দেখা দেয়।
খ. প্রায় ২ সপ্তাহকালীন সময় অব্যাহত থাকে।
গ. এ রোগ ব্যাকটেরিয়া জনিত।
চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ:
মাছের সংখ্যা কমিয়ে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করা। জীবানু মুক্ত পানিতে দুই সপ্তাহের মধ্যে মাছ স্বাভাবিকভাবেই আরোগ্য লাভ করে। বিশেষ কোন চিকিৎসার প্রয়োজন নেই।
প্রতিষেধক/প্রতিকার:
চুন প্রয়োগের মাধ্যমে পোনা মাছের লালন পুকুর প্রস্তুত করলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব এড়ানো যায়।
৭) রোগের নাম - মিক্সো-বোলিয়াসিস:
আক্রান্ত মাছের প্রজাতি - রুই জাতীয় মাছ
রোগেরলক্ষন ও কারণ:
মিক্সো-বোলাস প্রজাতির এককোষী প্রাণী রুই জাতীয় মাছের বিশেষ করে কাতলা মাছের ফুলকার উপরে সাদা কিংবা হালকা বাদামী গোলাকার গুটি তৈরী করে বংশ বৃদ্ধি করতে থাকে। ক্রমান্বয়ে ঐ গুটির প্রভাবে ফুলকায় ঘা দেখা যায় এবং ফুলকা খসে পড়ে। শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যাঘাত সৃষ্টিতে মাছ অস্থির ভাবে ঘোরাফেরা করে এবং খাবি খায়। শেষ রাতের দিকে ব্যাপক মড়ক দেখা যায়।
চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ:
ক. অদ্যাবধি এই রোগের সরাসরি কোন চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয় নাই।
খ. তথাপিও প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করলে পানির গুনাগুন বৃদ্ধি পেয়ে অম্লত্ব দূর হয়। পরজীবিগুলো ক্রমান্বয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং মাছ রোগ থেকে নিষ্কিৃতি লাভ করে।
প্রতিষেধক/প্রতিকার:
পুকুর প্রস্তুতকালীন সময়ে প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করে মাটি শোধন করা হলে আসন্ন মৌসুমে এ রোগের প্রকোপ থাকে না।
৮) পুষ্টির অভাবজনিত রোগ:
আক্রান্ত মাছের প্রজাতি : এ রোগে পুকুরে চাষযোগ্য যেকোনো মাছই আক্রান্ত হতে পারে।
লক্ষণ ও কারন:
ভিটামিন এ.ডি এবং কে-এর অভাবে মাছ অন্ধত্ব এবং হাড় বাঁকা রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। মাছের খাবারে আমিষের ঘাটতি দেখা দিলেও মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। অচিরেই মাছ নানা রোগের কবলে পড়ে।
প্রতিষেধক/প্রতিকার:
এসব রোগে আক্রান্ত মাছকে খাবারের সাথে প্রয়োজনীয় মাত্রায় সুনির্দিষ্ট ভিটামিন ও খনিজ লবণ মিশিয়ে খাওয়ানো হলে দ্রুত মাছের শারীরিক সুস্থ্যতা পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়।
৯) মাছের উকুন রোগ:
আক্রান্ত মাছের প্রজাতি : এ রোগে সাধারণত রুই মাছ, কখনো কখনো কাতল মাছও আক্রান্ত হতে পারে।
লক্ষণ ও কারণ:
গ্রীষ্মকালে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এ রোগে মাছের সারা দেহে উকুন ছড়িয়ে দেহের রস শোষণ করে মাছকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। এতে মাছ ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে মারা যায়।
প্রতিষেধক /প্রতিকার :
শতকরা আড়াই ভাগ লবণ দ্রবণে কিছু সময় আক্রান্ত মাছ ডুবিয়ে রাখলে উকুনগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়বে। এমতাবস্খায় হাত কিংবা চিমটা দিয়ে উকুনগুলো মাছের শরীর থেকে তুলে ফেলতে হবে।
CAJতথ্য : বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে সংগৃহীত ও সংকলিত ।
#আমি কোন মত্স্য বিশেষজ্ঞ নই । বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে উপস্থাপন করেছি মাত্র । কাংক্ষিত মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি মাছকে সম্পূরক খাদ্য প্রদান অত্যাবশ্যকীয়। মাছের রোগ হওয়ার পর চিকিৎসার পরিবর্তে মাছের রোগ যাতে না হয়, সে ব্যবস্থা আগেই গ্রহণ করাই উত্তম। কেননা, মাছ চাষের ক্ষেত্রে মাছের রোগ একটি বড় সমস্যা। বিভিন্ন রোগে যেমন মাছের মড়ক দেখা দেয়, পাশাপাশি মানসম্মত মাছ উত্পাদনের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়ে দাড়ায়। মাছের সাভাবিক বৃদ্ধি প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় । পরিশেষে খামারিদের বিশাল লোকসান গুনতে হয় ।
সর্বোপরি সঠিক পুকুর ব্যবস্থাপনা, যথাযথ নিয়ম-পদ্ধতি তথা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মাছ চাষ করা হলে চাষকৃত পুকুরে মাছের রোগ প্রতিরোধ করা অনেকাংশেই সম্ভব। পাশাপাশি লাভের সম্ভবনা বেড়ে যায় বহুগুণ ।
সকল মাছ চাষী বন্ধুদের জন্য শুভকামনা--চাষা আলামীন জুয়েল ॥
জীবিত প্রাণি রোগাক্রান্ত হবে, এটাই প্রকৃতিক নিয়ম এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মাছের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় না। তবে নানা কারণে উন্মুক্ত জলাশয়ের চেয়ে বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করা মাছে রোগাক্রমণ অনেক সময় কম বেশি হয়ে থাকে। পুকুর বা দীঘির মাছকে প্রায়ই নানান রোগের কবলে পড়তে দেখা যায়।আবদ্ধ পদ্ধতিতে চাষকৃত মাছ সচরাচর যেসব রোগে আক্রান্ত হতে পারে, এ ধরনের কয়েকটি সম্ভাব্য রোগ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করা হলো।
রোগের নাম/আক্রান্ত মাছের প্রজাতি/রোগের লক্ষন ও কারণ/চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ/প্রতিষেধক/প্রতিকারে নিম্মোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে ----
১) রোগের নাম - ছত্রাক রোগ (সেপ্রোল্গেনিয়াসিস):
আক্রান্ত মাছের প্রজাতি - রুই জাতীয় ও অন্যান্য চাষ যোগ্য মাছ।
রোগের লক্ষন ও কারণ:
আক্রান্ত মাছের ক্ষতস্থানে তুলার ন্যায় ছত্রাক দেখা দেয় এবং পানির স্রোত যখন স্থির হয়ে যায় কিংবা বদ্ধ জলায় অথবা হ্যাচারী ট্যাংকে যেখানে অনিষিক্ত ডিমের ব্যাপক সমাগম ঘটে, উহাতে ছত্রাক রোগ দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে। এমনি ধরনের প্রাকৃতিক জলাশয়ে প্রায় শতকরা ৯৮ ভাগ মাছের ডিম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেপ্রোলেগনিয়া প্রজাতি এ রোগের কারণ।
চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ:
ক. হ্যাচারিতে লালনকৃত ডিমগুলোকে ২৫০ পিপিএম ফরমালিন দিয়ে ধৌত করা।
খ. খাচা এবং পেনে চাষকৃত আক্রান্ত মাছগুলোকে শতকরা ৩-৫ ভাগ ফরমালিন দিয়ে ২-৩ মিনিট গোসল দেয়া।
গ. বিকল্প হিসাবে শতকরা ৫ ভাগ লবন পানিতে গোসল দেয়া যেতে পারে।
প্রতিষেধক/প্রতিকার:
ক. হ্যাচারীর প্রতিটি যন্ত্রপাতি ও ট্যাংক সম্পূর্ণরুপে পরিষ্কার করার পর শতকরা ১০ ভাগ ফরমালিন পানি দিয়ে ধৌত করা।
খ. অনিষিক্ত ও মৃত ডিমগুলোকে অবিলম্বে হ্যাচারি ট্যাংক থেকে সরিয়ে নেয়া এবং অধিক খাদ্য প্রয়োগ না করা।
২) রোগের নাম - মাছের ক্ষত রোগ: (ইপিজুটিকআরসারেটিভসিনড্রোম )
আক্রান্ত মাছের প্রজাতি - শোল, গজার, টাকি, পুঁটি, বাইম, কৈ, মেনি, মৃগেল, কার্পিও এবং তলায় বসবাসকারী অন্যান্য প্রজাতির মাছ।
রোগের লক্ষন ও কারণ:
এ রোগের মুল কারণ এ্যাফানোমাইসিস ইনভাডেনস্ নামক ছত্রাক দ্ধারা মূলতঃ মাছের মাংসপেশী আক্রান্ত হয়। এছাড়া কিছু ব্যবকটিরিয়া, প্রোটোজোয়া সংশ্লিষ্ট আছে বলে জানা যায়। রোগাক্রান্ত হওয়ার পূর্বে পানির গুনাগুনের অবনতি ঘটে, যেমন :
ক ) হঠাৎ তাপমাত্রার কমতি (১৯° সেঃ এর কম)।
খ ) পি, এইচ-এর কমতি (৪-৬)।
গ ) এ্যালকালিনিটির কমতি (৪৫-৭৪ পিপিএম)।
ঘ ) হার্ডনেস-এর কমতি (৫০-৮০ পিপিএম)।
ঙ) ক্লোরাইড এর স্বল্পতা (৩-৬ পিপিএম)।
মাছের ক্ষত রোগ চেনার উপায়:
আক্রান্ত মাছের গায়ে ক্ষত বা 'ঘা'জনিত লাল দাগ দেখা যায়। এই দাগের আকৃতি ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকবে। ঘায়ের স্থানে চাপ দিলে কখনো কখনো পুঁজও বের হতে পারে। মাছের লেজের গোড়া, পিঠ ও মুখের দিকেই বেশি ক্ষত হয়ে থাকে।
চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ:
ক. নিরাময়ের জন্য ০.০১ পিপিএম চুন ও ০.০১ পিপিএম লবন অথবা ৭-৮ ফুট গভীরতায় প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ১ কেজি হারে চুন ও ১ কেজি হারে লবন প্রয়োগ করলে আক্রান্ত মাছগুলো ২ সপ্তাহের মধ্যে আরোগ্য লাভ করে।
প্রতিষেধক/প্রতিকার:
ক. আগাম প্রতিকার হিসাবে আশ্বিন কার্তিক মাসে বর্ণিত হারে লবন ও চুনের প্রয়োগ করলে আসন্ন পরবর্তী শীত মৌসুমে মাছের ক্ষত রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়।
৩) রোগের নাম - ক্ষত রোগ:
আক্রান্ত মাছের প্রজাতি - সিলভার কার্প
রোগের লক্ষন ও কারণ:
ক. উপকূলীয় অঞ্চলে মাছ চাষের পুকুর বন্যায় প্লাবিত হলে ক্লোরাইডের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির (৩০ পিপিএম এর অধিক) ফলে কেবল মাত্র সিলভার কার্প মাছে দ্রুত ক্ষত রোগ দেখা দেয়।
চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ:
ক. আক্রান্ত পুকুরে তিন ভাগের দুই ভাগ পানি মিঠা পানির দ্ধারা পরিবর্তন করা।
খ. প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ৩/৪টি হারে চালতা ছেঁচে সারা পুকুরে ছড়িয়ে দিতে হবে।
প্রতিষেধক/প্রতিকার:
ক. বর্ণিতহারে চালতা প্রয়েগের ফলে ক্ষতরোগ আক্রান্ত সিলভার কার্প দ্রুত আরোগ্য লাভ করে।
খ. পুকুরকে বন্যামুক্ত রাখুন।
৪) রোগের নাম -পাখনা অথবা লেজ পঁচা রোগ:
আক্রান্ত মাছের প্রজাতি - রুই জাতীয় মাছ, শিং মাগুর ও পাঙ্গাস মাছ।
রোগের লক্ষন ও কারণ:
ক. প্রাথমিক ভাবে পিঠের পাখনা এবং ক্রমান্বয়ে অন্যান্য পাখনা আক্রান্ত হয়। এ্যারোমোনাড্স ও মিক্সোব্যাকটার গ্রুপের ব্যাকটেরিযা দ্ধারা এ রোগের সৃষ্টি হয়।
খ. পানির পি-এইচ ও ক্ষরতার স্বল্পতা দেখা দিলে এ রোগ দেখা দিতে পারে।
চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ:
ক. ০৫ পিপিএম পটাশযুক্ত পানিতে আক্রান্ত মাছকে ৩-৫ মিনিট গোসল করাতে হবে।
খ. পুকুরে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
প্রতিষেধক/প্রতিকার:
ক. রোগজীবানু ধ্বংসের পর মজুদকৃত মাছের সংখ্যা কমাবেন।
খ. প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করুন।
৫) রোগেরনাম - পেটফোলারোগ:
আক্রান্ত মাছের প্রজাতি - রুই জাতীয় মাছ, শিং মাগুর ও পাঙ্গাস মাছ।
রোগের লক্ষন ও কারণ:
ক. মাছের দেহের রং ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং পানি ও সঞ্চালনের মাধ্যমে পেট ফুলে যায়।
খ. মাছ ভারসাম্যহীনভাবে চলাচল করে এবং পানির ওপর ভেসে থাকে । অচিরেই আক্রান্ত মাছের মৃত্যু ঘটে।
গ. এ্যারোমোনাড্স ব্যাকটেরিয়া এ রোগের কারণ।
চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ:
ক. খালী সিরিঞ্জ দিয়ে মাছের পেটের পানিগুলো বের করে নিতে হবে। প্রতি কেজি মাছের জন্য ২৫ মিঃ গ্রাঃ হারে ক্লোরেমফেনিকল ইনজেকশন দিতে হবে। অথবা,
খ. প্রতি কেজি খাবারের সাথে ২০০ মিঃ গ্রাঃ ক্লোরেমফেনিকল পাউডার মিশিয়ে সরবরাহ করা।
প্রতিষেধক/প্রতিকার:
ক. প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করুন।
খ. মাছের খাবারের সাথে ফিশমিল ব্যবহার করুন।
গ. মাছকে সুষম খাদ্য সরবরাহ করবেন।
ঘ. প্রাকৃতিক খাবার হিসেবে প্লাংকটনের স্বাভাবিক উৎপাদন নিশ্চিত করুন।
৬) রোগের নাম - সাদা দাগ রোগ:
আক্রান্ত মাছের প্রজাতি - মৃগেল ও রুই মাছের পোনা।
রোগেরলক্ষন ও কারণ:
ক. পোনা মাছের আঁইশ, পাখনাসহ সারা দেহে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাদা দাগ দেখা দেয়।
খ. প্রায় ২ সপ্তাহকালীন সময় অব্যাহত থাকে।
গ. এ রোগ ব্যাকটেরিয়া জনিত।
চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ:
মাছের সংখ্যা কমিয়ে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করা। জীবানু মুক্ত পানিতে দুই সপ্তাহের মধ্যে মাছ স্বাভাবিকভাবেই আরোগ্য লাভ করে। বিশেষ কোন চিকিৎসার প্রয়োজন নেই।
প্রতিষেধক/প্রতিকার:
চুন প্রয়োগের মাধ্যমে পোনা মাছের লালন পুকুর প্রস্তুত করলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব এড়ানো যায়।
৭) রোগের নাম - মিক্সো-বোলিয়াসিস:
আক্রান্ত মাছের প্রজাতি - রুই জাতীয় মাছ
রোগেরলক্ষন ও কারণ:
মিক্সো-বোলাস প্রজাতির এককোষী প্রাণী রুই জাতীয় মাছের বিশেষ করে কাতলা মাছের ফুলকার উপরে সাদা কিংবা হালকা বাদামী গোলাকার গুটি তৈরী করে বংশ বৃদ্ধি করতে থাকে। ক্রমান্বয়ে ঐ গুটির প্রভাবে ফুলকায় ঘা দেখা যায় এবং ফুলকা খসে পড়ে। শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যাঘাত সৃষ্টিতে মাছ অস্থির ভাবে ঘোরাফেরা করে এবং খাবি খায়। শেষ রাতের দিকে ব্যাপক মড়ক দেখা যায়।
চিকিৎসা ও ঔষধ প্রয়োগ:
ক. অদ্যাবধি এই রোগের সরাসরি কোন চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয় নাই।
খ. তথাপিও প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করলে পানির গুনাগুন বৃদ্ধি পেয়ে অম্লত্ব দূর হয়। পরজীবিগুলো ক্রমান্বয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় এবং মাছ রোগ থেকে নিষ্কিৃতি লাভ করে।
প্রতিষেধক/প্রতিকার:
পুকুর প্রস্তুতকালীন সময়ে প্রতি শতাংশ জলাশয়ে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করে মাটি শোধন করা হলে আসন্ন মৌসুমে এ রোগের প্রকোপ থাকে না।
৮) পুষ্টির অভাবজনিত রোগ:
আক্রান্ত মাছের প্রজাতি : এ রোগে পুকুরে চাষযোগ্য যেকোনো মাছই আক্রান্ত হতে পারে।
লক্ষণ ও কারন:
ভিটামিন এ.ডি এবং কে-এর অভাবে মাছ অন্ধত্ব এবং হাড় বাঁকা রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। মাছের খাবারে আমিষের ঘাটতি দেখা দিলেও মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। অচিরেই মাছ নানা রোগের কবলে পড়ে।
প্রতিষেধক/প্রতিকার:
এসব রোগে আক্রান্ত মাছকে খাবারের সাথে প্রয়োজনীয় মাত্রায় সুনির্দিষ্ট ভিটামিন ও খনিজ লবণ মিশিয়ে খাওয়ানো হলে দ্রুত মাছের শারীরিক সুস্থ্যতা পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়।
৯) মাছের উকুন রোগ:
আক্রান্ত মাছের প্রজাতি : এ রোগে সাধারণত রুই মাছ, কখনো কখনো কাতল মাছও আক্রান্ত হতে পারে।
লক্ষণ ও কারণ:
গ্রীষ্মকালে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এ রোগে মাছের সারা দেহে উকুন ছড়িয়ে দেহের রস শোষণ করে মাছকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। এতে মাছ ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে মারা যায়।
প্রতিষেধক /প্রতিকার :
শতকরা আড়াই ভাগ লবণ দ্রবণে কিছু সময় আক্রান্ত মাছ ডুবিয়ে রাখলে উকুনগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়বে। এমতাবস্খায় হাত কিংবা চিমটা দিয়ে উকুনগুলো মাছের শরীর থেকে তুলে ফেলতে হবে।
CAJতথ্য : বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে সংগৃহীত ও সংকলিত ।
#আমি কোন মত্স্য বিশেষজ্ঞ নই । বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে উপস্থাপন করেছি মাত্র । কাংক্ষিত মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি মাছকে সম্পূরক খাদ্য প্রদান অত্যাবশ্যকীয়। মাছের রোগ হওয়ার পর চিকিৎসার পরিবর্তে মাছের রোগ যাতে না হয়, সে ব্যবস্থা আগেই গ্রহণ করাই উত্তম। কেননা, মাছ চাষের ক্ষেত্রে মাছের রোগ একটি বড় সমস্যা। বিভিন্ন রোগে যেমন মাছের মড়ক দেখা দেয়, পাশাপাশি মানসম্মত মাছ উত্পাদনের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়ে দাড়ায়। মাছের সাভাবিক বৃদ্ধি প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় । পরিশেষে খামারিদের বিশাল লোকসান গুনতে হয় ।
সর্বোপরি সঠিক পুকুর ব্যবস্থাপনা, যথাযথ নিয়ম-পদ্ধতি তথা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মাছ চাষ করা হলে চাষকৃত পুকুরে মাছের রোগ প্রতিরোধ করা অনেকাংশেই সম্ভব। পাশাপাশি লাভের সম্ভবনা বেড়ে যায় বহুগুণ ।
সকল মাছ চাষী বন্ধুদের জন্য শুভকামনা--চাষা আলামীন জুয়েল ॥

মন্তব্যসমূহ